Saturday, February 2, 2019

মাত্রাতিরিক্ত লবণ খাওয়া অবশ্যই কমাবেন, জেনে নিন এর ভয়ঙ্কর অপকারিতা!

অভ্যাস

মাত্রাতিরিক্ত লবণ গ্রহণ আমাদের স্বাস্থ্যের বহুবিধ মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে। সে সম্পর্কে জানার আগে প্রথমে জেনে নিই লবণ গ্রহণের স্বাভাবিক পরিমাণ কী এবং কীভাবে আমরা অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করে থাকি।

সুস্বাস্থ্যের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দিনে ১গ্রাম এবং শিশুদের জন্য আরও কম লবণ গ্রহণ যথেষ্ট। কিন্তু অধিকাংশ দেশেই একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দিনে ৭-১০গ্রাম লবণ গ্রহণ করে থাকেন। বাংলাদেশে এই লবণ গ্রহণের পরিমাণ আরও বেশি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে লবণ গ্রহণের গড় পরিমাণ দিনে ১৬ গ্রাম। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যদি লবণ গ্রহণের পরিমাণ অর্ধেক কমানো যায়, তাহলে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকে বিশ্বের প্রায় ২৫ লাখ লোকের মৃত্যু প্রতিহত করা সম্ভব হবে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কিছু নমুনা:
১. রান্নায় অতিরিক্ত লবণ দেওয়া: আমরা অনেকেই রান্না করার সময় তরকারিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণ দেই এবং আমরা প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি লবণে রান্না করা তরকারি খেতে অভ্যস্ত।
২. খাবার টেবিলে লবণদানী: আমরা অনেকেই খাবার সময় রান্না করা খাবারেও অতিরিক্ত লবণ যোগ করে খেতে পছন্দ করি এবং খাবার টেবিলে ছোট লবণদানী রাখি।
৩. কাঁচা ফলমূলে লবণ যোগ করে খাওয়া: আমরা অনেকেই কাঁচা ফলমূল খেতে অভ্যস্ত এবং কাঁচা ফলমূল খাওয়ার সময় আমরা তাতে লবণ যোগ করে খাই। বিশেষ করে মেয়েরা এটা বেশি করে।
৪. বিভিন্ন প্রাঙ্গনের ছোট দোকান হতে: আমরা প্রায়ই অবসর সময়ে হাঁটাহাটি করতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর গেট ও মাঠে ভ্রাম্যমাণ ছোট দোকান হতে আমড়া, গাজড়, শসা ইত্যাদি কিনে খাই এবং তা খাওয়ার সময় আমরা তাতে লবণ যোগ করে খাই।

এছাড়াও দেখা যায়, অনেকে খাওয়া শুরু করার আগেই জিহ্বাতে একটু লবণ দিয়ে নেন। খাবারকে সুস্বাদু করার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের উপাদান যেমন- কেচাপ, সয়াসস, টেস্টিং সল্ট, সালাদ বানানোর উপকরণ ব্যবহার করি; যেগুলোর মধ্যে অনেক লবণ থাকে।
লবণের কাজ খাদ্যকে পচন থেকে রক্ষা করা; এজন্য প্রক্রিয়াজাত এবং সংরক্ষিত খাবারে অধিক লবণ থাকে। বর্তমানে ব্যস্ত জীবনযাত্রার জন্য অনেকে বাজার থেকে উচ্চ লবণযুক্ত বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাবার কিনে আনেন। শুঁটকি মাছ, নোনা ইলিশে প্রচুর লবণ থাকে।
সিদ্ধ ডিম খেতে গেলে অনেকে লবণ দিয়ে খাই। মোট কথা, লবণ খাওয়া নিয়ে আমরা তেমন চিন্তাই করি না। শুধু জিহ্বার স্বাদের জন্য আমরা আমাদের মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনি।
চাইনিজ, ফাস্টফুড, স্যুপ, তেলে ভাজা খাবার, কাবাবসহ বিভিন্ন মজাদার খাদ্যে এত বেশি লবণ থাকে যে তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর! কিছু চাইনিজ খাবারে ২০ গ্রামেরও বেশি লবণ থাকে অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারিত পরিমাণের কয়েকগুণ।

অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ শরীরের যেসব অঙ্গ প্রত্যাঙ্গের ক্ষতি করে: মাত্রাতিরিক্ত লবণ গ্রহণ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যাঙ্গের ক্ষতি সাধন করে থাকে; হার্ট, লিভার এবং কিডনি তার মধ্যে অন্যতম।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ হয় এবং এতে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে যা হার্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ মারাত্মকভাবে হাড় ক্ষয় করে থাকে।
অধিক লবণ পাকস্থলীর ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত করে পাকস্থলী ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ কিডনি নষ্টের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি।

অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে যেসব রোগ হয়: অধিক লবণ গ্রহণের ফলে আমরা যেসব রোগে ভুগে থাকি, তা হল-

উচ্চ রক্তচাপ : সারা বিশ্বে ১৫০ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগের জন্য উচ্চ রক্তচাপ একটি প্রধান ঝুঁকি। উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ অধিক লবণ গ্রহণ। বিশ্বের যেসব জনগোষ্ঠী লবণ কম খান তাদের শতকরা ৮০ ভাগের উচ্চ রক্তচাপ থাকে না। উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের অধিক লবণ গ্রহণের ফলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে থাকে। লবণ কম গ্রহণ করলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। দীর্ঘদিন ধরে লবণ কম গ্রহণ করলে তা বৃদ্ধ বয়সে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা প্রতিরোধে সহায়তা করে। বাচ্চাদের কোনোভাবেই অধিক লবণ খেতে দেয়া যাবে না। কারণ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি শৈশব থেকেই শুরু হয়। বিশ্বে প্রতি বছর উচ্চ রক্তচাপে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়।

স্ট্রোক: প্রাপ্তবয়স্কদের শারীরিক অক্ষমতা এবং পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ স্ট্রোক। স্ট্রোকের জন্য উচ্চরক্তচাপ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। উচ্চ রক্তচাপের কারণে শতকরা ৬৪ ভাগের স্ট্রোক হয়ে থাকে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সব ধরনের স্ট্রোকের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেইলিওর: করোনারি হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক হওয়ার প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের ফলে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে যা হার্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে আমাদের রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় এবং হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেইলিওরের ঝুঁকি বেড়ে যায়। লবণ কম গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে সাহায্য করে, ফলে হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেইলিওরের ঝুঁকি কমে।

অস্টিওপোরোসিস : হাড়ের কর্মক্ষমতার জন্য ক্যালসিয়াম অপরিহার্য। হাড়ের ক্যালসিয়ামের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে লবণ গ্রহণের ভূমিকা আছে। অধিক লবণ গ্রহণ প্রস্রাবের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম নির্গমন বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমাদের হাড়ের ক্যালসিয়াম ক্ষয়ে হাড় পাতলা হয়ে যায় যাকে অস্টিওপোরোসিস বলে।

পাকস্থলীর ক্যান্সার : অধিক লবণ গ্রহণের ফলে পাকস্থলীর ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ইনফেকশন হতে পারে; এর ফলে পাকস্থলীর আলসার এবং পাকস্থলীর ক্যান্সার হয়। যে দেশের জনগোষ্ঠী বেশি লবণাক্ত খাদ্য গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে পাকস্থলীর ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতার হার অধিক থাকে।

কিডনি রোগ : উচ্চ রক্তচাপ মূত্রে প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস করার জন্য প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। যারা কিডনি রোগী, অধিক লবণ গ্রহণ তাদের রোগকে বাড়িয়ে দেয়। যেহেতু অতিরিক্ত লবণ প্রস্রাবের মাধ্যমে ক্যালসিয়ামের নির্গমন বাড়িয়ে দেয় সেহেতু এ ক্যালসিয়ামের কারণে কিডনিতে পাথর হওয়ার আশংকা থাকে। অধিক লবণ গ্রহণে শারীরিকভাবে স্থূল হওয়ার আশংকা বাড়ে এবং অ্যাজমার উপসর্গ বৃদ্ধি পায়।

অধিক লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার উপায়:
১. রান্নায় অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন; ধীরে ধীরে লবণ ব্যবহারের পরিমাপ ক্রমাগত কমিয়ে এনে কম লবণে অভ্যস্ত হোন।
২. রান্না করা খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ যোগ করে খাওয়ার অভ্যাস পরিহার করুন।
৩. কাঁচা ফলমূলে লবণ দিয়ে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৪. বিভিন্ন প্রাঙ্গনের ভ্রাম্যমাণ দোকান হতে আমড়া, গাজড়, শসা ইত্যাদিতে লবণ দিয়ে খাবেন না, আগেই বলে রাখুন লবণ ছাড়া দিতে।
৫. ফাস্টফুড, রেস্টুরেন্ট এবং ক্যান্টিনের খাবারে প্রচুর লবণ থাকে, এসব কম খান।
৬. লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।
৭. খাদ্য সংরক্ষণে লেবুর রস, ভিনেগার, কাঁচা রসুন, মসলা ব্যবহার করুন।
৮. খাদ্যকে সুস্বাদু করার উপাদান যেমন- কেচাপ, সয়া সস, সালাদ বানানোর উপকরণ কম ব্যবহার করুন।
৯. বড়িতে একেবারে কম লবণ দিয়ে সস, কেচাপ, আচার, সালাদ বা অন্যান্য খাদ্য তৈরি করুন।
(সম্পাদিত)

ভালো থাকুন | School of Awareness

No comments:

Post a Comment