Thursday, January 31, 2019

স্ট্রোক কী? স্ট্রোকে কী করনীয়?

রোগব্যাধি

হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যাওয়ার ঘটনা খুব কমন আমাদের দেশে । এই স্ট্রোক নিয়ে তথ্যবহুল ও উপকারী একটা লেখা পেলাম, পড়ে দেখতে পারেন, কাজে দিবে।

স্ট্রোক কি?
ব্রেইনের রক্ত সরবরাহ যখন কোন কারনে বিঘ্নিত হয় তখনই স্ট্রোক হয়। বিশেষ করে রক্ত নালী ব্লক হয়ে কিংবা রক্তনালী ছিড়ে ব্রেইনের এই রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হয় । রক্তে থাকে অক্সিজেন আর পুষ্টিগুন । ব্রেইন টিস্যুর খাদ্য হল এই অক্সিজেন আর পুষ্টিগুন । ফলে অক্সিজেনের অভাবে ব্রেইন টিস্যুগুলো মারা যায়। স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারন উচ্চরক্তচাপ!

স্ট্রোকের ভয়াবহতা:
সারাবিশ্বে স্ট্রোকে মৃত্যুর তৃতীয় কারণ ব্রেইন স্ট্রোক। বাংলাদেশে স্ট্রোকে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সারাবিশ্বে প্রতি ৬ জনে একজন স্ট্রোক করে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধতার সবচেয়ে বড় কারণ স্ট্রোক ।

স্ট্রোকের টাইপ :
সিডিসি (CDC= Center for disease control and prevention) এর মত অনুযায়ী ব্রেইন স্ট্রোক তিন ধরনের।
১. ইশকেমিক স্ট্রোক (Ischemic stroke): মস্তিষ্কের রক্তনালীর ভিতরে রক্ত জমাট (blood Clot) বেধে গেলে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে ব্রেইনের কিছু টিস্যূ অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। এটাই ইশকেমিক স্ট্রোক। বেশির ভাগ স্ট্রোকই ইশকেমিক স্ট্রোক!
২. হেমোরেজিক স্ট্রোক (Haemorrhagic Stroke): মস্তিষ্কের কোন রক্তনালী ছিঁড়ে গেলে এই ধরনের স্ট্রোক হয়!
৩. ছোট স্ট্রোক (Mini Stroke or Transient Ischemic Stroke - TIA): মস্তিষ্কের রক্তনালীতে অস্থায়ীভাবে অল্প কিছু সময়ের জন্য রক্ত জমাট বেধে এই স্ট্রোক সৃষ্টি করে; যেটা দ্রুতই আবার ভাল হয়ে যায়।

কি কি কারনে স্ট্রোক হতে পারেঃ
অনেকগুলো রিস্ক ফ্যাক্টর আছে, যেগুলো থাকলেই মূলত স্ট্রোক হওয়ার সম্ভবনা অনেক অনেক বেড়ে যায় । এই রিস্ক ফ্যাক্টর গুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১। কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর আছে যেগুলো আমরা কখনই নিয়ন্ত্রন করতে পারি না:
বয়স (age): বয়স বাড়ার সাথে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে থাকে, এটা আমরা নিয়ন্ত্রন করতে পারি না ।
লিঙ্গ (gender) : স্ট্রোক পুরুষদেরই বেশি হয়ে থাকে ।
২। মেডিকেল রিস্ক ফ্যাক্টর: কিছু কিছু মেডিকেল কন্ডিশন (সমস্যা) আছে যেগুলোর কারনে স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় ।

ট্রানজিয়েন্ট ইশকেমিক এটাক (TIA – Transient Ischemic Attack ): এটা স্ট্রোকের মতই, এর ফলে এক হাত পা এবং মুখের এক পাশ প্যারালাইসিস হয়ে যায়। আবার দ্রুত ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আগের মত ভাল হয়ে যায়। এটাকে আমরা মিনি স্ট্রোক বলতে পারি । এই মিনি স্ট্রোককে খুব সাবধানে নিতে হবে এবং দ্রুত চিকিৎসক দেখাতে হবে । কারন মিনি স্ট্রোক বড় স্ট্রোকের বার্তা দিয়ে যায় ।

অনিয়মিত হার্টবিট (Irregular pulse – Atrial fibrillation ): অনিয়মিত হার্টবিট স্ট্রোকের সম্ভবনা কে অনেকগুন বাড়িয়ে দেয় । তাই এটাকে চিকিৎসক দেখিয়ে চিকিৎসা করানো জরুরি ।

ডায়বেটিস (Diabetes ) : ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে না পারলে স্ট্রোকের সম্ভবনা অনেক গুন বেড়ে যায় ।

ফাইব্রোমাস্কুলার ডিসপ্লাসিয়া (FibroMuscular Dysplasia -FMD): এটাও স্ট্রোকের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়!

অথেরোস্ক্লেরোসিস (Atherosclerosis) : সিংহভাগ ইশ্চকেমিক স্ট্রোকের বড় কারণ এই অথেরোস্ক্লেরোসিস। কোলেস্টেরল, উচ্চরক্তচাপ এবং অধিক বয়সজনিত কারণে এই অথেরোস্ক্লেরোসিস হয়ে থাকে।

৩। লাইফ স্টাইলগত কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর: যেইগুলো আপনি নিজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারেন:
[] উচ্চরক্তচাপ 
[] উচ্চমাত্রার কোলস্টেরল 
[] ধূমপান 
[] অতিরিক্ত ওজন 
[] চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহন 
[] শারিরীক প্ররিশ্রম না করা 
[] অনেক বেশি অলকোহল পান করা

স্ট্রোকের লক্ষণসমূহঃ
→ হঠাৎ করে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা
→ হঠাৎ করে চোখে দেখতে সমস্যা (এক চোখ বা দুই চোখ) 
→ হঠাৎ করে তন্দ্রাচ্ছভাব হওয়া, হাঁটতে সমস্যা হওয়া ।
→ হঠাৎ করে করে কনফিউশন হওয়া এবং কথা বলতে অসুবিধা হওয়া ।
→ শরীরের এক পাশ হাত এবং পা অবশ হয়ে যাওয়া ।

স্ট্রোকের লক্ষণ সমূহ সহজে মনে রাখতে FAST শব্দটি মাথায় রাখুন
F = face, মুখ এক পাশে বেকে যায়
A = Arm, এক পাশে হাত পা অবশ হয়ে যেতে পারে
S = Speech, কথা বলতে অসুবিধা হবে ।
T = Time to call

উপরের লক্ষণ সমূহ দেখলেই কল দিতে পারেন 01787152872 (তথ্যের জন্য) এবং নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন ।

স্ট্রোক প্রতিরোধের নিয়ম সমূহঃ
ল্যানসেটের গবেষনা অনুযায়ী ৯০% স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য । তাই আসুন নিজে স্ট্রোক প্রতিরোধ করি এবং অন্যকে সচেতন করি ।

১। উচ্চরক্তচাপঃ উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারন । বছরে দুইবার অন্তত রক্তচাপ চেক করুন । রক্তচাপ বেশি হলে আপনার নিকটবর্তী হেলথ কেয়ার প্রফেশনালের সাথে যোগাযোগ করুন ।

২। আর্টিয়াল ফিব্রিলেশনঃ আর্টিয়াল ফিব্রিলেশন এক ধরনের অনিয়মিত হার্টবিট , যেটা স্ট্রোক ঝুঁকিকে ৫গুন বাড়িয়ে দেয় । দ্রুত আপনার হেলথ কেয়ার প্রফেশনালের সাথে যোগাযোগ করেন ।

৩। ধূমপান পরিহার করুনঃ ধূমপানের কারনে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুন বেড়ে যায়।

৪। উচ্চ কোলস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করুনঃ রক্তনালীতে উচ্চমাত্রার কোলস্টেরল ব্রেইনের রক্তনালীতে রক্ত প্রবাহ ব্লক করে দিয়ে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং হার্ট এটার্কের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় । আপনার চিকিৎসকের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করে চিকিৎসা নিন।

৫। ডায়বেটিসঃ ডায়বেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির স্ট্রোক ঝুঁকি ৪ গুন বেশি যাদের স্ট্রোক নেই তাদের চেয়ে । তাই ডায়বেটিস থাকলে ডায়বেটিস চিকিৎসকের পরামর্শমত চলবেন ।

৬। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খানঃ নিয়মিত কম চর্বিযুক্ত , কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খাবেন।

৭। মেডিসিনঃ মেডিসিন প্রেসক্রাইভ করা হয় স্ট্রোক রিকভারী এবং স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য। গবেষনায় দেখা গেছে অধিকাংশ স্ট্রোক আক্রান্ত রোগী ৩ মাসের মধ্যে মেডিসিন খাওয়া বন্ধ করে দেয় । আর এই গ্রুপের লোকজন পুনরায় স্ট্রোক আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি ।

৮। ব্যায়াম করুনঃ গবেষনায় দেখা গেছে যারা প্রতিনিয়ত ব্যায়াম করে তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক অনেক কম। শারীরিক কোন সমস্যা থাকলে অবশ্যই ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম থাকবেন।

বার বার স্ট্রোক কিভাবে প্রতিরোধ করবেনঃ
বার বার স্ট্রোক ( Recurrent stroke)! প্রতিরোধ আপনার হাতে....
স্ট্রোক হয়েছে মানে আপনার পুনরায় স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি সাধারনের চেয়ে ৪ গুন বেশি। প্রথম স্ট্রোক হওয়ার ৫ বছরের মধ্যে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪০% বেড়ে যায় ।
তবে আশার কথা হলো আপনি চাইলে ৮০% পুনরায় স্ট্রোক ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে পারেন শুধু মাত্র লাইফ স্টাইল এবং মেডিসিনের মাধ্যমে ।

পুনরায় স্ট্রোকে মৃত্যু ঝুঁকি আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি এবং পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস) এর হারও অনেক বেশি । কারন মস্তিষ্কের কিছু অংশ ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত, পুনরায় স্ট্রোক মানে মস্তিষ্কে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ।
আপনার প্রথমবার স্ট্রোক হওয়ার কারণগুলো বের করুন আপনার হেলথ কেয়ার প্রফেশনালের সাথে কথা বলে।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে The best defense is good offense , স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সেটা The best defense against recurrent stroke is good offense. অর্থাৎ ভালভাবে কারনগুলো প্রতিরোধ করতে পারলে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার কোন সুযোগই নেই।

নিম্নে পুনরায় স্ট্রোক ( Recurrent Stroke) প্রতিরোধের উপায় গুলো দেওয়া হল:
১। ধূমপান পরিহার করুনঃ ধূমপানের কারনে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুন বেড়ে যায় ।
২। উচ্চরক্তচাপঃ উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনযোগ্য (modifiable risk factor) । উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি দেড় গুন বেশি হয়ে থাকে ।
৩ । মেডিসিনঃ মেডিসিন প্রেসক্রাইভ করা হয় স্ট্রোক রিকভারী এবং স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য। গবেষনায় দেখা গেছে অধিকাংশ স্ট্রোক আক্রান্ত রোগী ৩ মাসের মধ্যে মেডিসিন খাওয়া বন্ধ করে দেয় । আর এই গ্রুপের লোকজন পুনরায় স্ট্রোক আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি ।
৪ । উচ্চ কোলস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করুনঃ রক্তনালীতে উচ্চমাত্রার কোলস্টেরল ব্রেইনের রক্তনালীতে প্রবাহ ব্লক করে দিয়ে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং হার্ট এটার্কের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় ।
৫। ডায়বেটিসঃ ডায়বেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির স্ট্রোক ঝুঁকি ৪ গুন বেশি যাদের স্ট্রোক নেই তাদের চেয়ে ।
৬। আর্টিয়াল ফিব্রিলেশনঃ আর্টিয়াল ফিব্রিলেশন এক ধরনের অনিয়মিত হার্টবিট , যেটা স্ট্রোক ঝুঁকিকে ৫গুন বাড়িয়ে দেয় । দ্রুত আপনার হেলথ কেয়ার প্রফেশনালের সাথে যোগাযোগ করেন ।
৭। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খানঃ নিয়মিত কম চর্বিযুক্ত , কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খাবেন ।
৮। ফিজিওথেরাপি নিনঃ স্ট্রোকের পরে সপ্তাহে কয়েকদিন ফিজিওথেরাপি বা নিয়মিত ব্যায়াম করলে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক অনেক কম ।

স্ট্রোকের চিকিৎসা :
স্ট্রোকের লক্ষনসমূহ বুঝার সাথে সাথে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। ৩ ঘন্টার মধ্যে চিকিৎসা দিতে পারে ৩১% রোগী ভাল হয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরতে পারে।

ল্যানসেটের গাইডলাইন অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।
একটু স্ট্যাবল হলে পুরোপুরি পূর্নবাসন চিকিৎসা শুরু করা দরকার। নিউরোলজিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পীচ থেরাপিস্ট, ফিজিশিয়ান, নার্স সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সঠিক পূর্নবাসনের মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর সর্বচ্ছো উন্নতি সম্ভব।

ধন্যবাদ 
ডাঃ সাইফুল ইসলাম, পিটি 
পরিচালক, বাংলাদেশ স্ট্রোক ফাউন্ডেশন।

ভালো থাকুন | School of Awareness

No comments:

Post a Comment