Monday, January 28, 2019

রাত জাগার ভয়ংকর অপকারিতা!

অভ্যাস


রাত জাগলে কী কী সর্বনাশ হতে পারে তা জেনে নিই।
ছোটকাল থেকেই আমরা এ কথাটি মোটামুটি সবাই শুনে অাসছি। তবে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ও আমাদের পরিবর্তিত আচরণ বা অভ্যাসের কারণে এ কথাটির প্রয়োগ তেমন না থাকলেও এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কিন্তু আমাদের উপর ঠিকই কুপ্রভাব ফেলছে।

১) মানসিক রোগঃ যারা রাতে ঠিকমত ঘুমায় না বা রাত জেগে থাকে তাদের মধ্যে বিষণ্নতা (Depression), অস্থিরতা (Anxiety), বিরক্তি (Irritability), হ্যালুসিনেশন (Hallucination) সহ নানাবিধ মানসিক রোগের বা উপসর্গের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায়। আর যারা ইতোমধ্যে এসব রোগে ভূগছেন তাদের রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। একারণে মানসিক রোগের চিকিৎসায় ঘুমের ঔষধের প্রয়োগ বেশ দেখা যায়।
২) স্মৃতি বা মেমোরী কমে যায়ঃ আমরা সারাদিন যা শিখি বা জানি তা ব্রেনে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে ঘুম অপরিহার্য্য। ঘুমের মধ্যে স্মৃতির Consolidation প্রক্রিয়ায় স্থায়ীরূপ লাভ করা সহজ হয়। রাতে ঠিকমত না ঘুমালে বা অপর্যাপ্ত ঘুমালে অর্জিত তথ্য স্মৃতিতে স্থায়ীরূপ লাভ নাও করতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে রাত জাগা ও অপর্যাপ্ত ঘুমানো ছাত্রদের একাডেমিক পারফর্মেন্স যারা স্বাভাবিক ঘুমায় তাদের তুলনায় কম। এ কারণেই পরীক্ষার আগের রাতে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশোনা করতে নিষেধ করা হয়।
৩) সতর্ক থাকার সক্ষমতা হ্রাস পায়ঃ কেউ যদি রাতে মাত্র দেড় ঘন্টা কম ঘুমায় তাহলে পরের দিন তার সতর্ক (Alertness) থাকার সক্ষমতা ৩২% কমে যায়। অসতর্কতার কারণে অনেক দূর্ঘটনাও ঘটে থাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব মেডিক্যাল রেসিডেন্ট (medical residents ) রাতে ৪ ঘন্টার কম ঘুমায় তারা যারা ৭ ঘন্টার বেশী ঘুমায় তাদের তুলনায় ২গুণ বেশী ভুল করে। তার চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হলো এক জরিপে দেখা গেছে ১১.৫% এরও কম মেডিক্যাল রেসিডেন্ট প্রতিদিন রাতে ৭ ঘন্টা ঘুমান। অথচ তাদের ভুল রোগীদের জীবনের সাথে সম্পর্কিত। এ কারণে চিকিৎসা পেশার সাথে সংলিষ্ট সকলের পর্যাপ্ত ঘুমের নিশ্চয়তা বিধান করা খুবই জরুরী।
৪) সড়ক দূর্ঘটনাঃ রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়ার পরিণতিতে ড্রাইভিং এর সময় তদ্রা, মনোযোগের অভাব, বিরক্তি, স্মতি বিভ্রাটজনিত সমস্যা, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াশীলতার ঘাটতিতে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ১লক্ষেরও বেশী সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে ১৫৫০জন নিহত হয় এবং আহত হয় প্রায় ৪০,০০০ মানুষ।
৫) মেজাজজনিত সম্পর্কের অবনতিঃ রাত জাগা মানুষদের দিনের বেলায় অস্থিরতা, বিরক্তি, অস্বস্থি বিরাজ করায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিষন্নতা কাজ করায় কিংবা কথা ভুলে যাওয়ার প্রবণতার কারণে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক সুস্থভাবে বজায় রাখা কঠিন হতে পারে; সেক্ষেত্রে মনোমালিন্য,কথা কাটাকাটি ও সহজেই উত্তেজিত হওয়ার কারণে নিকটজনদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।
৬) ভুল স্মৃতি বা False Memory তৈরি হওয়া: যারা রাতে পর্যাপ্ত ঘুমান না তাদের ভুল স্মৃতি তৈরি হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় অর্থাৎ যে ঘটনা ঘটেনি তার স্মৃতি তৈরি হওয়া। যেমন এক ব্যক্তি রাতে তার স্ত্রীকে হয়ত কিছুই বলেনি অথচ তিনি সকালে হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিতে পারেন এই বলে “তোমাকে কাল রাতে বললাম না খুব সকালেই আমাকে বেরুতে হবে, কাজেই নাস্তা রেডি রাখিও"।
৭) আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়ঃ যে সকল মানসিক রোগে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে তাদের বেশীর ভাগেরই অন্যতম উপসর্গ রাতে ঠিকমত ঘুম না হওয়া। গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন যেসব কিশোর কিশোরীরা রাতে ৫ ঘন্টার কম ঘুমায় তাদের বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৭১% বেশী এবং আত্মহত্যার চিন্তা ৪৮% বেশী এমন কিশোর কিশোরীদের তুলনায় যারা রাতে ৮ ঘন্টা ঘুমায়। রাত ১০টার পরে ঘুমালে আত্মহত্যার সম্ভাবনা প্রায় ২০% বেড়ে যায় এমনকি ৮ ঘন্টা ঘুমালেও।
৮) হার্টের সমস্যাঃ যারা রাতে ৬ঘন্টার কম ঘুমায় তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার বা নিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা খুব বেশী। তাছাড়া রাতজাগা রোগীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায়। সাধারণ মানুষের তুলনায় রাতজাগা মানুয়ের হৃদপিন্ডের অসুখ-বিসুখের ঝুঁকি প্রায় ৪০% বেশী। Warwick medical school এর গবেষকরা বলেছেন “যদি আপনি রাতে ৬ঘন্টার কম ঘুমান এবং ঘুম ঠিকমত না হয় তাহলে অাপনার হৃদরোগ হওয়ার বা তা থেকে মারা যাওয়ার সম্ভবনা ৪৮% বেশী এবং স্টোকে আক্রান্ত হওয়া বা থেকে মারা যাওয়ার সম্ভবনা ১৫% বেশী।"
৯) ডায়াবেটিসঃ ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। অর্থাৎ নিঃসুত ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়ায় তা ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে পরপর ৪ রাত ঠিকমত না ঘুমালে ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা ১৬% কমে যায় যা ওজন বৃদ্ধি, প্রি-ডায়াবেটিক ও ডায়াবেটিক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় এবং নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসকে অনিয়ন্ত্রিত করতে পারে। জাপানের এক গবেষণা পত্রে দেখা যায় রাত জেগে কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব দিনে কাজ করা শ্রমিকদের তুলনায় প্রায় ৫০% বেশী।
১০) ওজন বৃদ্ধিঃ রাত জেগে থাকলে শরীরে কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায় যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর এই গ্লুকোজের রেসপন্সে বেশী করে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। কিন্তু রাতের বেলা মাংসপেশীর নড়াচড়া কম থাকায় বা খাদ্যের চাহিদা কম থাকায় ইনসুলিন এই গ্লুকোজকে ফ্যাট সেলে চর্বি হিসাবে জমা হতে সাহায্য করে। তাছাড়া রাত জেগে থাকলে ক্ষুধা নিবারণকারী লেপটিনের(Leptin) মাত্রা কমে যায় এবং ক্ষুধা উদ্রেককারী গ্রেলিনের (Ghrelin) মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে সামগ্রিক ক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদে শরীরের ওজন বাড়ে।
১১) দেহের বৃদ্ধি কমে যেতে পারেঃ ঘুমের মধ্যে দেহের বৃদ্ধির জন্য দায়ী Growth Hormone এর নিঃসরণ বেশী হয় এবং এসময় দেহের বৃদ্ধির হারও বেশী থাকে। রাতের বেলা উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই অনেক সময় শিশুদের জয়েন্টে ব্যথা হয় (জয়েন্টের কাছাকাছি হাড়ের অংশে দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী এপিফাইসিয়াল প্লেট থাকে যা বৃদ্ধির সময় ব্যথার অনুভূতি তৈরি করে)। সুতরাং যারা রাতে ঠিকমত ঘুমান না (বিশেষত শিশু ও টিনএজারদের ক্ষেত্রে) তাদের দেহের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে।
১২) ব্রেস্ট ও ওভারীর ক্যান্সারঃ মার্কিন এক গবেষণায় জানা গেছে যেসব কর্মজীবি নারীরা রাত জেগে কাজ করেন তাদের স্তন ও ডিম্বাশয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি যারা শুধু দিনের বেলায় কাজ করেন তাদের তুলনায় যথাক্রমে ৩০% ও ৪৯% বেশী।
১৩) পেটের সমস্যাঃ যারা রাত জাগেন তাদের মধ্যে বুক জ্বালাপোড়া করা, পেপটিক আলসার, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, ইরিটেবল বাউয়েল সিনড্রোম(IBS), ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য সহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
১৪) ক্ষত সারানোঃ দ্রুত ক্ষত সারাতে (Healing) গভীর ঘুমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অাছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যারা রাতে স্বাভাবিকভাবে ঘুমায় তাদের শরীরের হিলিং প্রসেস যারা রাত জাগে তাদের তুলনায় দ্রুততর হয়।
১৫) রিপ্রডাকশন ও সেক্সঃ রাত জাগা মহিলাদের অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা, অকালে সন্তান প্রসব, কম ওজনের সন্তান হওয়া, ব্যাথাযুক্ত মাসিক এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তান না হওয়ার মত সমস্যা হতে পারে। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত ঘুমকে বন্ধ্যাত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে বিবেচনা করছেন। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে যেসব নারী-পুরুষ রাতে ঠিকমত ঘুমায় না তাদের যৌনাকাঙ্খাও (Libido) কমে যেতে পারে।
১৬) শরীর ব্যাথা ও ম্যাজম্যাজ করাঃ যাদের রাতে ঠিকমত ঘুম হয় না তাদের শরীরে ব্যাথা বা ম্যাজম্যাজ ভাব লেগেই থাকে। চিকিৎসা শাস্ত্রে শরীর ব্যাথার Fibromyalgia নামক রোগটি বা রোগটির উপসর্গের তীব্রতা রাত জাগা মানুষদের মধ্যে তুলনামূলক বেশী দেখা যায়।
১৭) ক্লান্তিবোধঃ ঘুমের মাধ্যমে দেহ বিশ্রাম নেয় পরবর্তী সময়ের জন্য দেহকে পূর্ণ কার্যক্ষম করে তোলার জন্য। কিন্তু যারা রাত জাগে এবং পর্যাপ্ত ঘুমায় না তাদের পরবর্তী দিন ক্লান্তিতে ভূগতে দেখা যায়।
১৮) মাইক্রোস্লিপ (Microsleep)-মাইক্রোস্লিপ হলো কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ করে কয়েক সেকেন্ড থেকে ৩০ সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে পড়া এমনকি কাজ করা অবস্থায়ও। যারা রাত জাগেন এবং পর্যাপ্ত ঘুমান না তাদের মধ্যে মাইক্রোস্লিপের প্রবণতা বেশী দেখা যায়। যারা ড্রাইভিং করেন বা মেশিন চালান তাদের জন্য এ অবস্থা মারাত্মক দূর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণ হতে পারে।
১৯) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসঃ দীর্ঘদিন ধরে রাত জাগার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। বিশেষতঃ ভাইরাসজনিত রোগবালাইয়ে ভোগার সম্ভবনা বেশ বেড়ে যায়।
২০) প্রদাহ বৃদ্ধিঃ যারা রাত জেগে কাজ করেন তাদের রক্তে প্রদাহ নির্দেশক (inflammatory makers) যেমন interleukin 6 (IL-6), tumor necrosis factor-alpha (TNF-α) এবং C-reactive protein (CRP) বেশী থাকে। কোন কোন গবেষক রাতজাগাকে Low-grade chronic inflammation এর সাথে তুলনা করেছেন। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন রাত জাগাজনিত যত সমস্যা হয় তার বেশীরভাগ সমস্যার পিছনে রয়েছে এই মৃদু মাত্রায় দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ। হয়ত এ কারণেই রাতজাগাদের শরীরে জ্বর জ্বর ভাব, শরীর ব্যাথা/ম্যাজম্যাজ করা বা মাথাব্যাথা করার মত উপসর্গ প্রায়ই দেখা দেয়।
২১) মাথাব্যাথাঃ যারা রাতে ঠিকমত ঘুমান না তাদের মাথাব্যাথা হওয়ার ও মাইগ্রেনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশী দেখা যায়।
২২) মৃগীরোগ ও খিঁচুনী বেড়ে যায়ঃ গবেষণায় দেখা গেছে রাত জাগা মৃগীরোগীদের খিঁচুনীতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা রাতে স্বাভাবিকভাবে ঘুমায় এমন মৃগীরোগীদের তুলনায় বেশী।
২৩) ডার্ক সার্কেল ও ব্যাগি আইঃ যারা ক্রমাগত রাত জাগে তাদের চোখের চারপাশে কালো দাগ বা ডার্ক সার্কেল তৈরি হয়। কারো কারো চোখের নিচ ফুলে উঠে(Baggy eye)।
২৪) অঞ্জনি(STYE): যারা রাত জাগে বেশী তাদের চোখের পাতায় অঞ্জনি (STYE) হওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়।
২৫) জিনঃ মানবদেহে এমন কতকগুলো জিন অাছে যাদের কার্যকারিতা দিবরাত্রি চক্র (circadian rhythm) মেনে চলে। এদের সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ১৫০০। রাত জাগার কারণে এসব জিন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এসব জিন ক্ষতিগ্রস্থ হলে দেহে নানা রকম জটিলতা স্থায়ীরূপ নিতে পারে।
২৬) নৈতিকতার অধপতনঃ যারা রাত জাগেন ও পর্যাপ্ত সময় ঘুমান না তাদের নৈতিকতার বিচারবোধ হ্রাস পেতে পারে। নৈতিকতার বিচারবোধ হ্রাস পাওয়ায় তার দ্বারা অহেতুক অনৈতিক কাজ সম্পন্ন হতে পারে।
২৭) অতিরিক্ত হাই তোলাঃ যারা রাত জাগেন তাদের মধ্যে দিনের বেলা অতিরিক্ত হাই তোলার প্রবণতা দেখা যায়।
(সংগৃহীত)

ভালো থাকুন | School of Awareness

No comments:

Post a Comment